![দৈনিক নোয়াখালীর কথা]( https://dailynoakhalirkatha.com/wp-content/uploads/2023/04/logo-noyakhali.png )
পিয়েরে ট্রুডো ছিলেন কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী। পেশায় আইনজীবি হলেও রোমান্টিক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ৪৯ বছর বয়সে তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী হন।
তখন পর্যন্ত পিয়েরে ট্রুডো ছিলেন ব্যচেলর। প্রেম করতেন হলিউড গায়িকা এবং অভিনেত্রী বারবা স্ট্রাইস্যান্ড-এর সাথে। তাদের বিয়ে হওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু কী কারণে যেন পিয়েরে মন ঘুরিয়ে ফেলেন।
১৯৭১ সালে হুট করেই শোনা গেল পিয়েরে বিয়ে করে ফেলেছেন তার থেকে ২৯ বছরের ছোট এক তরুণীকে। সেটাও কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে। অনেকটা গোপনে। ২২ বছরের ওই তরুনীর নাম মার্গারেট সিনক্লেয়ার।
এই দুজনের সম্পর্ক টিকে ছিল মাত্র ৬ বছর। ১৯৭৭ সালে তারা সেপারেশনে যান। পিয়েরে ট্রুডো কানাডার ইতিহাসে দায়িত্বে থাকাকালীন বউয়ের সঙ্গে আলাদা হওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পিয়েরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৮৪ সালে তাদের ডিভোর্স হয়।এই দম্পতি তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। প্রথমজন জাসি্টন ট্রুডো, দ্বিতীয় অ্যালেক্সান্ড্রে ট্রুডো এবং সবচেয়ে ছোট মিচেল ট্রুডো।
পশ্চিমে বিয়ে ভাঙা বিশেষ দোষের কিছু নয়; তবে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারা মর্যাদার ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় প্রধানদের জন্য তা হয়তো খানিক দায়িত্বও।
‘ব্রোকেন ফ্যামিলি’র সন্তান হিসেবে জাসি্টন ট্রুডো যখন বড় হচ্ছিলেন, বাবা-মা’র বিচ্ছেদ তো তাকেও খানিক পুড়িয়েছিল। তার মনের ওপর এর প্রভাব পড়েছিল।
জাসি্টন ট্রুডো সে কারণেই চেয়েছিলেন কোনো একজনের সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে।
সহিত্যে স্নাতক জাসি্টনও বাবার মতো রোমান্টিক মানুষ। তবে রাজনৈতিক আবহে বড় হতে হতে নিজেও রাজনীতির রাস্তায় হেঁটেছেন। ব্যস্ত রাজনীতিক হওয়ার আগেই তার প্রেম হয়ে যায় ছোট ভাই মিচেলের ক্লাসমেট সোফি গ্রেগোয়ারের সঙ্গে।
সোফিকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। তবে সম্পর্কটা তৈরি হয় বড়বেলাতেই।
সোফি তখন ব্যস্ত বিনোদন সাংবাদিক। জাসি্টনের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি তিনি। নিজেকেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে হয়েছে। শুরু করেছিলেন একটা অ্যাড ফার্মের রিসেপশনিস্ট হিসেবে। নিজের যোগ্যতা এবং মেধা দিয়ে দেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের হোস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন।
দু’জনের কাছে আসা এক চ্যারিটি শোয়ের উপস্থাপক হিসেবে। তারা ছিলেন ওই শোয়ের কো-হোস্ট। এই শোয়ের মাধ্যমে জাসি্টন এবং সোফি নতুন করে কাছে আসেন।
কিছুদিন বাদেই সোফি ইমেল করেন ট্রুডো’র কাছে। জানান তার ভালোলাগার কথা। কিন্তু জাসি্টন সেই ইমেইলের কোনো জবাব দেননি। জবাব না পেয়ে সোফি বেশ অপমানিত বোধ করেন। মনে মনে ভাবেন, জাসি্টনের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবেন না।
তাই কি হয়? এক গ্রীষ্মে তাদের ফের দেখা হয়ে যায়। সুদর্শন, স্বতস্ফূর্ত জাসি্টনকে কোনোভাবেই এড়াতে পারেননি সোফি। ট্রুডো এবার সোফিকে প্রস্তাব দেন তার সঙ্গে দূরে কোথাও বেড়াতে যাবার।
সোফি শর্ত দেন— আগে ইমেইলের জবাব দিতে হবে। জাসি্টন এবার আর না করেননি। এভাবেই এ দু’জন প্রানবন্ত মানুষ দুজনের ভালোবাসার মোহে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেন।
এই গল্পগুলো ২০০৩-২০০৪ সালের। এরপর তারা অবশ্য দেরি করেননি। ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর, জাসি্টনের বাবার জন্মদিনে তাদের এনগেজমেন্ট হয়ে যায়। এক বছর পরই ১৮০ জন অতিথির উপস্থিতিতে জাসি্টন ট্রুডো এবং সোফি গ্রেগোয়ার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
এর পরের গল্প সবার জানা। ট্রুডো-সোফি দম্পতি রূপকথার মতো বিশ্বের সামনে হাজির থেকেছেন। এমন হাসি-খুশি দম্পতি জগতে মেলা ভার।
বিয়ের ১০ বছর পর জাসি্টন ট্রুডো কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ট্রুডো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ এবং সম্পদশালী দেশের প্রধানমন্ত্রী। অথচ জগতজুড়ে তার মানবিক গুণেরই খবর বেশি। অন্যদিকে সোফিও মানবিক বউ হিসেবে সব সময় স্বামীর পাশে থেকেছেন। সংবেদনশীল এ দম্পতি জন্ম দিয়েছেন তিনটি সন্তান।
প্রায় ১৮ বছর সংসার করার পর তারা হুট করেই আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
নিয়তির কী পরিহাস! বাবার মতোই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাকে বিচ্ছেদের ঘোষণা দিতে হলো। অথচ তিনি চেয়েছিলেন যেন বাবার মতো তার সংসার না ভাঙ্গে। সোফিকে বিয়ের সময় ঘোষণাও দিয়েছিলেন— আমি আজীবন সোফির সঙ্গে থাকতে চাই।
জাসি্টন ট্রুডোর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর বিচ্ছেদ হয়েছিল ৫৮ বছর বয়সে। তারপর তিনি নতুন করে প্রেমে পড়েছিলেন কানাডিয়ান অভিনেত্রী মার্গোট কিডারের। সে সম্পর্কও টেকেনি। পরবর্তীতে কানাডিয়ান সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ইউনিভার্সিটি শিক্ষক ও লেখক ডেবোরা কোয়েনের সন্তানের বাবা হয়েছিলেন।
বাবার তুলনায় জাসি্টন ট্রুডো কিছুটা কমবয়েসি, ৫২। তার সামনে পাড়ি দেয়ার মতো অনেক সময় পড়ে রয়েছে। কীভাবে পাড়ি দিবেন, নতুন কোনো সম্পর্কে তিনি জড়াবেন কি-না, তা অজানা। আপাতত তার বিচ্ছেদ বিরহটাই অনুভবনীয়।
বিচ্ছেদ মানেই তো কষ্ট। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন সে পথে হাঁটেন, সে কষ্ট হয়ে ওঠে বহুমুখী। প্রেসিডেন্টের জীবন তো আর দশজনের মতো নয়! সংসার টিকিয়ে রাখার নৈতিক দায়িত্বও প্রধানমন্ত্রীদের থাকে। ট্রুডোর মতো মানবিক প্রধানমন্ত্রীরা হয়তো সে দায়িত্ব আরো সফলভাবে পালন করতে চান।
আপাতদৃষ্টে পৃথিবীর সফলতম মানুষদের একজন জাসি্টন ট্রুডো। কানাডার মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীই শুধু হননি, মানবিক মানুষ হিসেবে জয় করে নিয়েছেন সমগ্র পৃথিবীর মানুষের। ক্ষমতা, সংসার, সন্তান— আর কী পাওয়ার বাকি ছিল তার যার জন্য বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে হল?
সব কিছুর উর্ধে্ব জাসি্টন ট্রুডো একজন মানুষ। একজন মানুষ যখন তার ভালোবাসার কাউকে হারায়, শুধু মানুষ হিসেবেও কি তা কম যাতনার?
শুধু জাসি্টনের কথাই বা কেন বলা। সোফিও কি একই যাতনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন না? ভাবতে অবাক লাগে— ট্রুডোর মতো হ্যান্ডসাম, সম্পদশালী, ক্ষমতাবান, মানবিক পুরুষও তাকে সুখী করতে পারল না?
তবুও বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে হয়। বিস্মৃত হয় কাছে থাকার, আজীবন পাশে থাকার অঙ্গীকার।
সে কারণেই বঙ্গদেশের কবিগুরু বলেছিলেন— তোমরা যে বল দিবসও রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা, সখী, ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?
সোহেল অটল: সাংবাদিক ও লেখক
atol.bd@gmail.com
আপনার মতামত লিখুন :