![দৈনিক নোয়াখালীর কথা]( https://dailynoakhalirkatha.com/wp-content/uploads/2023/04/logo-noyakhali.png )
ছায়েদ আহমেদ : এতদ্অঞ্চলের বিদ্যাপীঠসমূহে একসময় নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং মূল্যবোধ ছিলো জাগ্রত। আর্থিক টানাপোড়েন শিক্ষার পথে বাঁধার কারণ ছিলো না। কালপরিক্রমায় এখন তা বাণিজ্যিক, দায়সারা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বিংশশতাব্দীর পড়াশোনার প্রেক্ষাপট থেকে তাই অনুপ্রেরণা নেওয়ারও যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি। শিক্ষাব্যবস্থার এ যুগের মনগড়া কৌশল, অনলাইন ভিত্তিক পড়াশোনা কিংবা পড়াশোনার সহজপ্রাপ্যতা প্রভৃতির দরুন শিক্ষার্থীরা সাধনা বিষয়টির সাথে পরিচিত হতে পারছে না। যেমনটি এনালগ যুগে ছিল বলে আমরা জানি। ঐতিহাসিক সূত্র মতে দ্বীপাঞ্চল হাতিয়া-র বয়স প্রায় ৫ হাজার বছরের অধিক হলেও, হাতিয়ায় শিক্ষার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু এই তো কিছু দিন আগে অর্থাৎ ১৮৮০ সালের দিকে অথবা এর কিছু আগে-পরে।
প্রথমদিককার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে অন্যতম হাতিয়া শিশু পাঠ জগমোহন স্কুল। তখনকার জ্ঞান পিপাসুদের হাতে গড়ে উঠেছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এসব প্রতিষ্ঠান বেশিদিন টিকেনি। মূলত হাতিয়ায় শিক্ষা বিস্তার শুরু হয় ১৯১২ সালে হাতিয়া ইউনিয়ন মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এবং এর কিছুদিন পর রহমানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী, মানবিক এবং দানশীল ব্যাক্তিদের দয়ায় মক্তব ভিত্তিক এবং জাগির ভিত্তিক পড়াশোনা চলে আসছে। কথা হচ্ছে, যখন থেকে এই যে শিক্ষার বীজ বপণ হলো এরপর থেকে হাতিয়ার শিক্ষা ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছিলো! দেশের নামকরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতিয়ার শিক্ষার্থীরা জ্যোতি ছড়াতে থাকে।
কিন্তু বিগত এক যুগ ধরে শিক্ষার গুণগত মান একেবারে তলানিতে; এর বহুবিধ কারণ উল্লেখ্য, প্রথমত-ক্রমানুপাতিক হারে বাড়ানো হচ্ছে পাসের হার, সেই সাথে জিপিএ-৫ এর উচ্চাকাঙ্খা। পরীক্ষার হল গুলোতে অসদুপায় এবং বাহির থেকে সাপোর্ট দিয়ে দিন দিন এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটানো হচ্ছে। দ্বিতীয়ত-যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে স্কুলে পড়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই স্মার্টফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ নানান ধরণের সফটওয়্যারে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা। সেই সাথে অনেকে হারিয়ে যায় পাবজি, ফ্রি-ফায়ার, টিকটকসহ আধুনিক নানাবিধ নেশাময় ভিডিও গেমসে। হাতিয়ার স্কুল-মাদ্রাসা ভিত্তিক ৪র্থ থেকে ১০ম শ্রেণি ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরিপে উঠে আসে প্রায় অধিকাংশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট রয়েছে বা আনাগোনা রয়েছে।
শতকরা হিসেবে প্রায়ই ৮৫% শিক্ষার্থীর একাউন্ট আছে। এদের মধ্যে কারও একটা কারও দুই তিনটাও আছে।
তৃতীয়ত-মাধ্যমিক পর্যায়ে রাজনীতির যে ছড়াছড়ি তার সরাসরি প্রভাব শিক্ষার উপর ফেলছে। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষমতার একটা দাম্ভিকতা চলে আসে যা আসলেই ভয়ানক, তারা ধুমপান, ইভটিজিং সহ যে কোনো নিন্দনীয় কাজ করতে দ্বিধা করে না।
চতুর্থত-হাতিয়াতে সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থানে আছে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা। যার সূচনা প্রাথমিক পর্যায় থেকে। ২০২৪ খৃঃ শুরুর মাস শেষ হয়ে গেলেও পাঠদানে মনোযোগী হতে দেখা যায়নি কোথাও। বিদ্যালয় মাঠে খেলাধুলা, দুষ্টমি, এসেম্বলি আর দুপুর হতে না হতে গৃহে ফিরতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। হাতিয়ার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে লক্ষ করা গেছে বেশিরভাগ শিক্ষকই স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিন্দু মাত্র ভাবে না। স্কুলে এসে নিজেদের সাংসারিক প্রলাপ করে। দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া এখানে একদিকে নেই যেমন ভালো শিক্ষক তেমনই অন্য দিকে নেই সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনা। যথারীতি পাঠদানের চেয়ে এখানে ঐতিহ্যের নাম বেচে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট শিক্ষা নিয়ে বেশি আগ্রহী। আগ্রহ এমন পর্যায়ে গেছে যে প্রাইভেট এখন বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করেছে। ক্লাস থেকে প্রাইভেটে বেশি গুরুত্ব দেয় তারা। করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো বন্ধ থাকলেও দেদারসে চলছিলো প্রাইভেট বাণিজ্য।
সেই থেকে শিক্ষকদের একাংশের মনে লোভ প্রবলভাবে দানা বাঁধে। ছাত্ররা যেমন নোংরা রাজনীতির সাথে জড়িত তেমনি দিন দিন শিক্ষকরাও এর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারাও স্কুল-ছাত্র-শিক্ষকতা নিয়ে কিংবা শিক্ষার মান নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
উপরোল্লিখিত সকল কারণ গুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার ক্রমহ্রাসমান অবস্থার উপর। যেমন-গত এইচএসসি পরীক্ষা-২০২৩ এ হাতিয়ার একমাত্র সরকারি উচ্চ বিদ্যাপীঠ হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজে মারাত্মক ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। কলেজটির ৩১৬ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে মাত্র ৭৫ জন। এছাড়া ২০২১-২০২২ খ্রিস্টাব্দে হাতিয়া থেকে মাধ্যমিক পাসের পর নটরডেম, হলিক্রস এবং সেন্ট জোসেফ উচ্চমাধ্যমিক- এ ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় টিকেছে মাত্র ৬-৭ জন। ২০২৩ ’র এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন মাত্র টিকেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে। কিন্তু এর কয়েক বছর আগেও দেশসেরা সকল কলেজে হাতিয়ার শিক্ষার্থীদের বিচরণ ছিল লক্ষনীয়ভাবে।
পরীক্ষার হলের অবস্থা যদি হাতিয়ার বাহিরের শহরাঞ্চলের মত কড়াকড়ি হত তাহলে বোধহয় যে কয়টা এ+ আসে সে কয়টা পরীক্ষার্থী পাস করতো কিনা সন্দেহ। শিক্ষার নিম্নমুখী এমন অবস্থার পাশাপাশি সমান তালে অধঃপতন হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধেরও।
এই তো গেলো সমস্যার কথা। সমস্যা উত্তরণের নানাবিধ উপায় উল্লেখ্য শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট বিমুখীকরণ এবং ক্লাসমুখীকরণ অন্যতম প্রধান সমাধান। ক্লাসে ছেলেমেয়েরা দিনের সর্বোচ্চ সময় পার করে সেখান থেকে শিখার সুযোগ হচ্ছে বেশি। কিন্তু প্রাইেেভর সময়কাল যেখানে ৪০-৪৫ মিনিট, সেখানে তেমন কিছু শেখানোর সুযোগ হয়ে উঠে না।
আপনার মতামত লিখুন :