• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট : ৮ মার্চ, ২০২৪

যন্ত্রপাতি ও জনবল সংকটে ধুঁকছে হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

উপজেলা প্রতিনিধি, হাতিয়া : জনবল সংকট আর মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি নিয়ে চলছে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সেবা কার্যক্রম। প্রতিদিনই উপচে পড়া রোগীদের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত ডাক্তার নার্সদের। অপরদিকে সংস্কার বিহীন ও যুগ অনপোযোগী চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সেবা প্রত্যাশী রোগীদের। ফলে ব্যাহত হচ্ছে দ্বীপবাসীর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ১ জন শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। বিধি মোতাবেক ৩১ ডাক্তারের স্থলে টিএইচওসহ মাত্র ১১ জন থাকলেও ৬ জনই ট্রেনিং ও ছুটি জনিত কারণে হাতিয়ার বাইরে থাকায় বর্তমানে উপস্থিত মাত্র ৫ জন ডাক্তার।

অন্যদিকে ৪১ জন নার্সের স্থলে ২৮ জনের পদই শূন্য রয়েছে। কাগজে কলমে ১৩ জন দেখালেও উপস্থিত রয়েছেন মাত্র ৬ জন। হাতিয়া ৫০ শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিনই প্রায় শতাধিক রোগীর সেবা প্রদানে মাত্র ৬ জন নার্সকে ২৪ ঘণ্টা রোটেশনে সেবা দিতে গিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠছেন। ফলে সেবা প্রার্থী মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
একইভাবে ওয়ার্ড বয়, আয়া ও সুইপারের পদ খালি না থাকলেও কর্মস্থলে তাদের কেউ হাজির থাকেন না বলে জানা যায়। তাদের কেউ ডিপুটেশনে হাতিয়ার বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু মাসিক বেতন ভাতা উত্তোলন করেন হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। ফলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আগত সেবা প্রার্থীদের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
সাড়ে ৭ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দ্বীপ উপজেলার একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র এ হাসপাতাল। ১৯৯৮ সাল থেকে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বিগত বছর ধরে কোন ভবন না থাকায় বেড সংখ্যা একই রয়েছে। কেবল মাত্র ৫০ জন রোগীর জন্য খাবার ও ঔষধ পত্রের সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ এ হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে প্রায় শতাধিক। অনেক সময় রোগীদেরকে করিডোরে, চলাচলের পথে, ডাস্টবিন সংলগ্ন খোলা জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। দুর-দূরান্তের সেবা প্রত্যাশীরা যানবাহন ভাড়া দিয়ে কষ্ট করে এসেও কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

হাসপাতালটিতে রোগ নির্ণয়ে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কাজে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তার মধ্যে দু’একটি ছাড়া সবগুলোই মান্ধাতার আমলের এনালগ সিস্টেমের বলে জানা যায়। ডিজিটাল যুগে এসব যন্ত্রপাতি দিয়েই কোনো রকমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কার্যক্রম চালাতে হয়। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এখন অনেক পরীক্ষারই রিপোর্ট ঠিকমতো দেয়া সম্ভব হয় না। দীর্ঘ ২০ বছর ধরেই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে এক্সরে মেশিন। কাজ করছে না আলট্রাসনোগ্রাাম মেশিনটিও। মেশিনগুলো বিকল থাকার কারণে রোগীরা হাসপাতাল থেকে ভালো মানের চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ফলে দিন দিন বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি।

শুধু তাই নয়, দায়িত্বরত কয়েকজন সাব-এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের রয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবের ব্যবসা। তারা বেশীর ভাগ রোগীকে দায়িত্বরত অবস্থায় তাদের সেই সকল প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবে যেতে উৎসাহিত করে। তার উপর রয়েছে দালালদেরও উপদ্রব। তারা অপকৌশলে রোগীদের প্রাইভেট মেডিকেল এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবে নিতে বাধ্য করে। এমনকি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তিসহ চিকিৎসায়ও নানা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। অতিরিক্ত ফ্রি দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাম গঞ্জ থেকে আসা অনেকে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়। এতে প্রতিনিয়তই অসংখ্য মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকালে উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নারী, শিশু, বয়স্ক প্রচুর রোগীর চাপ। কয়েকটি বেডে দুজন রোগী এক সাথে বসে আছে। অনেকে আবার নিঝুম দ্বীপসহ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে বেড না পেয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। এক মা তার এক দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ফ্লোরে সেবা নিতে ও দেখা যায়।

বুড়িরচর ইউনিয়নের রহমত বাজার এলাকা থেকে আসা ইরাজ উদ্দিন নামে এক রোগীর বাবা বলেন, ছেলেকে নিয়ে গত পরশু হাসপাতালে এলে ডাক্তার এক্সরেসহ কিছু পরীক্ষা করতে বলেন। রিপোর্টে নিউমোনিয়া সনাক্ত হলে ভর্তির আদেশ দিলে দেখা যায় ছিট খালি নাই। বিকল্প একটা সিটে রোগীকে নিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক বসে থাকার পরেও কোন নার্স আসেনি। পরে আমি উত্তেজিত হয়ে গেলে নার্স এসে ক্যানোলা করে ইনজেকশন পুশ করে। কিন্তু বাথরুমের নোংরা পরিবেশ, টয়লেটের দুর্গন্ধ সহ্য করে আজ ২ দিন সেবা নিতে গিয়ে আমার স্ত্রী নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

দায়িত্বরত নার্স ইনচার্জ মোহছেনা আক্তার তামান্না বলেন, দু’একদিন পরপরই রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকে। অনেক দিন থেকে আমাদেরকে বেড সংখ্যার তিনগুণ রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোটেশান মাফিক স্টাফ নার্স সংখ্যা ৩ জন। অধিক সংখ্যক রোগীদের একত্রে সমানভাবে সেবা দিতে পারা যায় না। সেবা দিতে বিলম্ব হলে রোগীদের দুর্ব্যবহারও শুনতে হয়। আমাদের কিছুই করার থাকেনা।

আলাপ কালে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সৌমেন সাহা জানান, শয্যা ও লোকবল বৃদ্ধির বিষয়ে স্থানীয় এমপি মহোদয় এবং সিভিল সার্জনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। আমি সকল অনিয়মের বিষয়ে প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সম্প্রতি সার্বিক অনিয়মতান্ত্রিক কারণগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন পূর্বক ডিবিশনাল পরিচালক মহিউদ্দিন মহোদয়কে অবহিত করা হলে তিনি ভিজিট করে যাওয়ার পরেও কোন সুরাহা হয়নি।

হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীর তুলনায় যে লোকবল রয়েছে তা যথেষ্ট নয়। গড়ে এখানে ৯০ থেকে ১০০ রোগী ভর্তি থাকে। কিন্তু সামান্য লোকবল দিয়ে রোগীদের সেবা দেয়া খুবই দুষ্কর।

হাসপাতালে এক্সরে আলট্রা ইসিজিসহ বেশ কিছু প্যাথলজি পরীক্ষা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষার জন্য যে সরঞ্জামগুলো রয়েছে তা এনালগ হলেও বেশির ভাগ সচল রয়েছে। তবে হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে, অসাধু চক্রের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। আমি এসকল বিষয়ে কিছু করতে চাইলে বিভিন্ন ভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি।

জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মাসুম ইফতেখার মুঠোফোনে হাসপাতালের সার্বিক বিষয়ে জানান, ইতোমধ্যে গর্ভবতী মায়েদের সেবার লক্ষ্যে দুইজন ডাক্তার দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের এক্সরেটি আমরা খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আগামী সপ্তাহ থেকে এখানে আলট্রা চালু হবে।

চতুর্থ শ্রেণির লোকবল ডেপুটেশনে থাকার বিষয়ে তিনি জানান, হাতিয়ার কোন লোক যদি কোথায়ও এভাবে থেকে থাকে তাদেরকে নিজ কর্মস্থলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। দালালের দৌরাত্ম্য নিয়ে অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, টিএইচওকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে।

আরও পড়ুন