• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১৪ মার্চ, ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট : ১৪ মার্চ, ২০২৪

মাইজদীতে ব্যাঙের ছাতার মতো অবৈধ ক্লিনিক আর হাসপাতাল বাড়ছেই

স্টাফ রিপোর্টার : সরকারি নানা উদ্যোগ ও সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সেবা দানে গাফিলতি ও দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যকে পুঁজি করে জেলা জুড়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েই চলেছে। জেলা শহর মাইজদী যেন এক হাসপাতালের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

এরপরও প্রকৃত চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ রযেছে। সেবা নয়, এখানে বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এসব হাসপাতাল আবার তিলকে তাল বানিয়ে এক দিকে যেমন রোগীদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে, অন্য দিকে ভুল ও অপচিকিৎসার ফাঁদে পড়ে অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, ২৫০ শয্যা নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালকে কেন্দ্র করে জেলা শহর মাইজদীর হাসপাতাল রোডের দুই পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক।বেসরকারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি তুলনামূলক অনেক বেশি, চিকিৎসকরা দালাল চক্র ও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল থেকে চুক্তিভিত্তিক পল্লী চিকিৎসকদের পাঠানো রোগীদের থেকে কমিশন দিতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব হাসপতালের অধিকাংশই রোগী ভর্তি করে শুধুমাত্র আবাসন সুবিধা দিয়ে লাখ লাখ টাকার বিল হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময়ই রোগীদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারি সুবিধা দিতে পারে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসাসেবার ওপর ভরসা করতে না পেরে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে যাচ্ছেন, আর সেখানে অতিরিক্ত খরচ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না। দুই-একটি ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ব্যবহারও ঠিকমতো নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্থানীয় সিভিল সার্জন অফিসকে ম্যানেজ করে চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। অভিযানে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও প্রভাবশালীদের ছত্র ছায়ায় ফের চালু হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানা গেছে, একটি ১০ শয্যা হাসপাতাল চালু করতে তিনজন এমবিবিএস মেডিকেল অফিসার, চারজন ডিপ্লোমা চিকিৎসক, ছয় জন স্টাফ নার্স ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র থাকার নিয়ম থাকলেও নোয়াখালীতে বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ হাসপাতাল দালালের মাধ্যমে জোরপূর্বক রোগী ভর্তি করে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা দিচ্ছে। চার-পাঁচটি ব্যতীত অধিকাংশই মানছে না সরকারি নিয়ম। নেই কোনো বৈধ কাগজপত্রও। কিছু হাসপাতালের লাইন্সেস থাকলেও মিলছে না কোনো হালনাগাদ তথ্য।

এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, হাসপাতাগুলোতে নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, ভুল চিকিৎসা, রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায় ও স্বজনদের লাঞ্ছিত করে থাকে।

জানা গেছে, নোয়াখালী ৯ উপজেলায় ৪১৬ প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক রয়েছে। এর বেশিরভাগই জেলা সদর মাইজদিতে। ২০২২-২৩ সালে নবায়ন রয়েছে ৩৯টি,২০২১-২২ সালে ৯৩টি, ২০২০-২১সালে ১১৪টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। রেজিস্টেশন নবায়ন করলেও ডাক্তার ও নার্সের কাগজপত্র ভুয়া, ডাক্তার ও নার্সের মোবাইল নাম্বারে স্থলে হাসপাতালের মালিক,কর্মচারী ও আয়াদের নাম্বার দেয়া আছে। সম্প্রতি স্ব্যাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অভিযানে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হলেও সবগুলে একে চালু হয়েছে।

দালালের মাধ্যমে জোরপূর্বক রোগী ভর্তি করে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা বিষয়ে জেলার প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম ভট্ট বলেন, কোনো প্রকার দালাল চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়ার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরকারের নিয়ম না মানলে বিষয়টি সরকার দেখবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জেলায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, শূন্য পদে চিকিৎসক, নার্স ও টেশনিশিয়ানসহ জনবল দ্রুত নিয়োগ করতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালুর ব্যবস্থাসহ অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সবার সঙ্গে সমন্বয় করেই স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে হবে এবং যা আছে, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তাহলে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাণিজ্য পরাজিত হয়ে সেবাটাই প্রধান হয়ে উঠবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলার সাধারণ সম্পাদক আবু নাছের মঞ্জু জানান, নোয়াখালী জেলায় এখনো একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। জেলার জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ গ্রামে বসবাস করলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান এখনও সীমিত। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে জেলা শহর মাইজদীতে অবস্থিত ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালই জরুরি চিকিৎসাসেবার একমাত্র স্থান। এখান থেকে দালাল চক্র নিমূর্ল এবং ডাক্তার ও নার্সদের সমন্বয়ে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে সাধারণ মানুষ আর বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হবেন না। আর্থিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা পাবেন।

নারী অধিকার জোটের সভানেত্রী লায়লা পারভিন জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে অন্তঃসত্ত্বা ও তার স্বজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে স্বাভাবিক প্রসব না করিয়ে সিজার করে একজন মাকে পঙ্গু করে দেয়। ফলে অনেক সময় মা ও শিশুর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। এর থেকে রক্ষার জন্য সরকার যদি জেলার সব ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা নিশ্চিত করে, তাহলে সাধারণ মানুষ অদক্ষ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে দূরে রাখতে পারেন। তাহলে এক দিকে মা ও শিশুর ঝুঁকি কমে আসবে, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বাণিজ্যের পাশাপাশি সঠিক সেবা দিতে বাধ্য হবে।

সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন,বিশাল জনগোষ্ঠীর জেলা নোয়াখালীতে শতভাগ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বৈধ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছে। এ রকম অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারি নিয়ম না মানায় অনেক হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। আর যেসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন না নিয়ে অবৈধ প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান চালিয়ে সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছি।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আমরা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। প্রতিটি মাসিক সমন্বয় সভায় জেলায় স্বাস্থ্যসেবার সাফল্য-ব্যর্থতা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এরই আলোকে জেলার স্বাস্থ্যসেবায় অনিয়ম প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দালালদের প্রতিরোধ করতে কয়েকবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়েছে। আগামীতেও এমন অভিযান চলবে।

আরও পড়ুন