• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১৯ মে, ২০২৩
সর্বশেষ আপডেট : ১৯ মে, ২০২৩

দ্রব্যমূল্য কমাতে আমরা যা করতে পারি : ড. মতিউর রহমান

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি আজকাল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমন অস্বাভাবিক, অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক হারে বাড়ছে যে তারা হতাশায় ভুগছে।

নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ, মূল্যবৃদ্ধির এ ধাক্কা সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করতে পারে। কাজেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করি, তাহলে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে যাবে, তেমনি মুনাফাখোরদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। মনে রাখতে হবে বাজারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই, তবে আমরা সচেতন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি কমতে বাধ্য। এসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে

করোনা অতিমারির কারণে গত আড়াই বছরে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। অনেকেরই বেতন-ভাতা তেমন বাড়েনি। আবার বিভিন্ন অজুহাতে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দিচ্ছে। কোথাও কোথাও ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটছে। জিনিসপত্রের দাম না কমলে এসব মানুষের কী অবস্থা হবে তা খুব সহজেই অনুমেয়।

যাই হোক, মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে টিসিবির পণ্যের গাড়ি বা ওএমএসের পণ্যের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের দীর্ঘ সারি দেখতে হবে। সব ধরনের দ্রব্যসামগ্রীর দামই বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি শুধু কাঁচামালের বাজারকে উত্তপ্ত করেনি, শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা উপকরণ কিনছে তার দামও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে সব ধরনের কসমেটিকস ও ডিটারজেন্ট সামগ্রীর দাম বেড়েছে। সম্প্রতি চিনি ও পেঁয়াজের দাম আরেক দফা বেড়েছে।

অনেকের মতে, দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণগুলো হলো- ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার প্রতি আসক্তি, যেকোনো পণ্যের অবৈধ মজুত, খাদ্যসামগ্রী বা বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও জ্বালানির ঘাটতি, ন্যায্য ও নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ না করা, যথাযথ বাজার তদারকির অভাব ইত্যাদি। তবে এসব বিষয়ের পাশাপাশি গ্যাস, তেল ও বিদ্যুৎ সংকট বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও বাজার নিয়ন্ত্রণকে কঠিন করে তুলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অযথা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সরকারের যথাযথ তদারকির অভাব, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ইত্যাদি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী বলেও অনেকে মনে করেন। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বেশ চাপ সৃষ্টি করেছে। এভাবে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়ছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব খরচ মেটানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ক্রমশ একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে উঠছে। এ সমস্যা সমাধানে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি হলো মজুতদারি, সিন্ডিকেট এবং কালোবাজারি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বাজারে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। অধিক উৎপাদনশীল ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কল-কারখানার সুষ্ঠু উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ওপর কড়া নজরদারি রাখতে হবে এবং পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সতর্ক থাকতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে আমাদের অর্থনীতিতে দ্রুত চাপ সৃষ্টি করবে। তাই সরকারের উচিত এখনই সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি করা দরকার তা হলো বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিকারী দুর্বৃত্তদের নির্মূল করতে হবে।

আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অবৈধভাবে পণ্য মজুত না করে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এমনকি আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। পচনশীল খাদ্যপণ্যের যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে হবে। দেশে প্রতি বছর ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। সুতরাং, খাদ্যপণ্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অপচয় রোধের পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মূলত, আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করি, তাহলে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে যাবে, তেমনি মুনাফাখোরদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। মনে রাখতে হবে বাজারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই, তবে আমরা সচেতন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতি কমতে বাধ্য। এসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

আরও পড়ুন